শিবালয় উপজেলার অক্সফোর্ড স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। অর্থ-আত্মসাৎ, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের জমি নিজের নামে লিখে নেওয়া, শিক্ষকের বেতন না দেওয়া, উন্নয়ন ফান্ডের নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগে দুর্নীতি, বিবিধ নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় ও কোষাগারে হিসেব না রাখাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বহিষ্কারও হয়েছিলেন একবার।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অক্সফোর্ড স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ করে তারা। হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করছেন।
এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনকে ১৫ দিনের ছুটিতে পাঠিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও ইউএনও। গঠন করা হয়েছে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ড নামে একটি কেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। অথচ আব্দুল মতিন প্রধান শিক্ষক পদে যোগদানের তারিখ উল্লেখ করেন ১৯৯৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি যোগদান করেন। বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক রাজা মিয়া যোগদান করেন ২০০৬ সালে। অথচ তার নিয়োগ দেখানো হয় ১৯৯৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। শিক্ষক রাজা মিয়ার সার্টিফিকেট ভুয়া হওয়ায় তার এমপিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এরইমধ্যে তিনি বেতন হিসেবে সরকারি বিপুল অংকের টাকা তুলে নেন।
সূত্র জানায়, ২০০৭ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় অক্সফোর্ড স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ওই বছর কেজি স্কুল প্রাইমারি স্কুল হিসেবে এমপিও হয়। ২০১০ সালে সরকার বিদ্যালয়টিকে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে এমপিওভূক্তি করে। এসময় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে উন্নয়নের নামে ৬ লাখ টাকা নেওয়া হয়। এই টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন আব্দুল মতিন।
জানা যায়, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হাফিজুর রহমান খান হিরু নামে এক ব্যক্তি ৬১ শতক জমি দান করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানের আয়ে পর্যায়ক্রমে কেনা হয় ৭৭ ও ৩৩ শতক জমি। এরমধ্যে ৩৩ শতক জমি দেওয়া হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যালয়ের নামে জমি রয়েছে ১৪০ শতাংশ। বাকি জমি প্রধান শিক্ষক তার নিজের নামে লিখে নিয়েছেন।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে বিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের অডিট করেন। অডিটে প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬৪৯ টাকা দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। আর ২০১০-১১ অর্থ বছরে দুই লাখ ৫৫ হাজার ১০ টাকা দুর্নীতির প্রমাণ পায় অর্থ কমিটি। এরপর অর্থ-আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ৩৪ মাস বহিষ্কার থাকার পর তদবির করে আবারও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব নেন তিনি।
কেজি স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিও হওয়ার পর তার নজর যায় কলেজ প্রতিষ্ঠায়। ২০১৪ সালে মাত্র ১৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু করেন আব্দুল মতিন। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর আবারও তার বাণিজ্যের দরজা খুলে যায়। শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন রেখা রাণী দত্ত। তার ৮ লাখ টাকা বেতন বকেয়া করা হয়েছে। ওই শিক্ষক মানবেতর জীবন যাপন করলেও তার বেতন পরিশোধ করছেন না আব্দুল মতিন।
এদিকে বিবিধ নামে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন বছর ধরে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে কোন রেজুলেশন করা হয় না। এমনকি কোষাগারে এ টাকা জমা করাও হয় না। প্রধান শিক্ষকের দাবি, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিষ্ঠানের কাজে স্পিড মানি দেওয়া হয়, যে টাকা হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। বিবিধ নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকা স্পিড মানি হিসেবে খরচ করা হয়।
যেভাবে বহাল তবিয়তে আব্দুল মতিন: অক্সফোর্ড স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মুন্নু গ্রুপ অব কোম্পানির কর্ণধার মরহুম শিল্পপতি হারুন অর রশীদকে দাতা সদস্য করা হয়। হারুন অর রশীদ খান মুন্নু তখন দপ্তর বিহীন মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বড় মেয়ে আফরোজা খান রিতাকেও দাতা সদস্য করা হয়। সেসময় তাদের সহযোগিতা পান আব্দুল মতিন।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক গড়ে তোলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রকৌশলী আনোয়ারুল হকের সঙ্গে। এ যাত্রায় রক্ষা পান তিনি। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হন ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয়। ঠিক এ সময়ই অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে বহিষ্কার হন তিনি। কোন উপায় না পেয়ে তাঁর সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলেন আব্দুল মতিন। আবারও অপকর্মের সুযোগ পান এবং অপ্রতিরোধ্যভাবে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যান। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এসএম জাহিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে ছুটে যান তাঁর কাছে। প্রধান অতিথি করে বিদ্যালয়ে নেন। তাঁকে পটিয়ে বড় অংকের একটি বরাদ্দও পান আব্দুল মতিন। তবে বরাদ্দ বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই সরকার পতন হয়।
সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে।
তবে তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন। তার দাবি, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
জানতে চাইলে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন বলেন, অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত করছে। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।